চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে সাত বছরে হয়নি একবারও পরিদর্শন। নাট-বোল্ট খুলে নিচ্ছে মাদকসেবী ও দুর্বৃত্তরা, নষ্ট হচ্ছে শত কোটি টাকার সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প। সিটি করপোরেশনের অবহেলায় কি বড় দুর্ঘটনার অপেক্ষা?
চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার এখন আর কেবল যান চলাচলের সেতু নয়—এটি হয়ে উঠছে নগর-পরিকল্পনায় অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের প্রতীক। নির্মাণের পর সাত বছরেও হয়নি একটি পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন বা রক্ষণাবেক্ষণ। ফ্লাইওভারের নাট-বোল্ট খুলে নিচ্ছে মাদকসেবী কিশোরেরা, নিরাপত্তা বেষ্টনী চুরি হয়ে যাচ্ছে, অথচ কর্তৃপক্ষ কেবল “কমিটি গঠন” ও “চিঠি দেওয়ার কথা” বলেই দায়িত্ব এড়াচ্ছে।
২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হয় ২০১৭ সালে, ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার গাড়ি চলাচল করে এই ফ্লাইওভার দিয়ে।
ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে প্রতি বছর পরিদর্শনের সুস্পষ্ট গাইডলাইন থাকলেও ২০২৫ সাল পর্যন্ত একবারও তা মানা হয়নি।
এমনকি সিডিএ নিজে ২০২২ সালে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি বলে জানালেও সেটি পড়ে থাকেছে ফাইলবন্দি।
সম্প্রতি সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশ থেকে নাট-বোল্ট খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
স্টিল গার্ডারের সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
যান চলাচল চলমান অবস্থায় গার্ডার বা গ্রিল হঠাৎ খুলে পড়া মানেই একটি বড় দুর্ঘটনার সূত্রপাত।
স্থানীয় দোকানদার রহিম মিয়া জানান, মাদকসেবী কিশোর-যুবকরা দল বেঁধে গ্রিল ও নাট-বোল্ট চুরি করছে।
ভয়েই কেউ কিছু বলছে না।
নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে আরও ১৫ কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভারের নিচে লাগানো হয় ৯০ হাজার গাছ, স্থাপন করা হয় ঝরনা ও সাবমারসিবল পাম্প, হাঁটাপথ ও শত শত বাতির পোল।
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন সব গাছ মরে গেছে, বাতি নেই, টাইলস ভাঙা।
একটুকু সৌন্দর্যও টিকে নেই।
ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ‘ট্রেড ম্যাক্স’-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করা হয় দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে।
তবে আগের প্রতিষ্ঠান আদালতে রিট করলে সৃষ্টি হয় আইনি জটিলতা।
এর ফলে প্রায় এক বছর ধরে কোনো প্রতিষ্ঠানই ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণ করছে না।
সিটি করপোরেশনের সচিব বলছেন,
আদালতের স্থগিতাদেশের সময় পেরিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু পুরনো ঠিকাদার বলছেন, এখনও কার্যকর আছে স্থগিতাদেশ।
এই টানাপড়েনের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নিরাপত্তা।
বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন দায়িত্বে আসার পর চুক্তি বাতিল করেছেন, কিন্তু বিকল্প কার্যকর কোনো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারেননি।
জননিরাপত্তার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
অথচ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য একঘেয়ে—”চিঠি দেব”, “কমিটি গঠন করব”, “দেখছি”।
ফ্লাইওভারের গার্ডার থেকে নাট-বোল্ট খুলে যাওয়া মানে চলমান গাড়ির ওপর তা পড়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।
যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
২০২৪ সালের মোহাম্মদপুর মার্কেটের ছাদ ধস কিংবা মগবাজার ফ্লাইওভার দুর্ঘটনা আমাদের সতর্ক করেনি?
জননিরাপত্তা নিয়ে গাফিলতির কোনো অজুহাত চলে না।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার এখন কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতার নিদর্শন নয়, এটি হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবনের প্রতি অশ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি।
এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে, পরবর্তী সংবাদ শিরোনাম হয়তো হবে—“ফ্লাইওভার ধসে প্রাণহানির ঘটনা”।
