২০২৪-২৫ সালে হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। সহিংসতা উপেক্ষা, একতরফা প্রতিবেদন ও সেনাবাহিনীর ওপর চাপ—জাতিসংঘ কি নিরপেক্ষ, নাকি ভূ-রাজনীতির হাতিয়ার?
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপর্যয়ের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে এই আগস্টে। এই সময়ে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ নতুন এক অভিযোগের ঝাঁপি খুলেছে—তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রসংঘও (UNO) ছিল ওই আন্দোলন ও সরকারের পতনের এক প্রকার নীরব সহযাত্রী। এমনকি, সরাসরি প্ররোচনাও এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে।
আওয়ামী লিগের এই অভিযোগ নিছক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়—বিশ্লেষকরা বলছেন।
জাতিসংঘের আচরণ ও বিবৃতিগুলি খতিয়ে দেখলে এক গভীর রাজনৈতিক পক্ষপাতের আভাস মেলে, যা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও বড় প্রভাব ফেলছে।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত রাজনৈতিক সংঘর্ষগুলোর একটি।
সরকারি স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ, কারাগারে জঙ্গিমুক্তি, পুলিশের ওপর নৃশংস আক্রমণ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি।
অথচ জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক ২৫ জুলাই এক বিবৃতিতে এই ভয়াবহ সহিংসতার কোনও উল্লেখ না করে একতরফাভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি জানান।
তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দিলেও বনানীতে পরিদর্শক মাসুদ পারভেজকে পুড়িয়ে হত্যা, কিংবা এএসআই মোক্তাদিরকে ঝুলিয়ে হত্যার মতো ঘটনায় ছিল গভীর নীরবতা।
একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার এমন পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক নীতিমালার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে উঠেছে বিস্তর প্রশ্ন।
আরও বিস্ময়কর হলো মার্চ ২০২৫-এ বিবিসি ‘হার্ড টক’ অনুষ্ঠানে ভলকার তুর্কের দেওয়া বক্তব্য।
যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যদি আন্দোলন দমনে অংশ নেয়, তাহলে তাদের শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করা হবে।
এমন একটি হুমকি কার্যত সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, এবং দেশের নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়ে।
ফলে আন্দোলন আরও হিংস্র রূপ নেয়।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন,
এমন চাপ কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ওপর প্রয়োগ করা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এটি একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটে বাইরের হস্তক্ষেপের স্পষ্ট নজির।
ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ১,৪০০ জন নিহত হয়।
অথচ এই রিপোর্টে সহিংসতার উৎস বা সংগঠকদের নাম না থাকা, এবং সরকার পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত অনুপস্থিতি স্পষ্ট করে, এই রিপোর্ট একতরফা।
আওয়ামী লিগ বলছে,
এই তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে বিরোধী দল ও এনজিওগুলোর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
এটি শুধু আওয়ামী লিগ নয়, বরং গোটা দেশের গণতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা ও সার্বভৌমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
২০২৫ সালের ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, আর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কোঅর্ডিনেটর গোয়েন লুইস।
এরপর ২৯ জুলাই জাতিসংঘ আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের পাশে থাকার জন্য প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা জানান।
বিশ্লেষকেরা বলছেন,
রাষ্ট্রসংঘ ও ইউনূস সরকারের এই সম্পর্ক নিছক সহানুভূতির নয়—বরং পূর্ব পরিকল্পিত রাজনৈতিক সমঝোতার বহিঃপ্রকাশ।
ড. ফারুক হোসেনের ভাষায়,
“জাতিসংঘ আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় নৈতিক সমর্থন দিয়েছে।
এটি একটি গণতান্ত্রিক দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক বৈধতা প্রদান, যা গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থান।”
রাষ্ট্রসংঘ যখন আন্দোলনকারীদের সহিংসতা উপেক্ষা করে, সেনাবাহিনীকে হুমকি দেয়, এবং একতরফা মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে—তখন প্রশ্ন উঠেই যায়, এই সংস্থা কি আদৌ নিরপেক্ষ?
নাকি এটি পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন,
“বাংলাদেশ এখন একটি ভূরাজনৈতিক ল্যাবরেটরি—জাতিসংঘ এখানে এক ধরনের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।
গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক প্রকৌশলই এখন নয়া হস্তক্ষেপের রূপ।”
রাষ্ট্রসংঘের কাজ মানবাধিকার, শান্তি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা।
কিন্তু ২০২৪-২৫ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কর্মকাণ্ড অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রকৌশলের অংশ বলেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশ কি এখনো একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র?
নাকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ‘পরীক্ষার ক্ষেত্র’?
আর রাষ্ট্রসংঘ কি সেই পরীক্ষার অবজেকটিভ পরীক্ষক, নাকি কোনও পক্ষবিশেষের সহায়ক?
এই কলামে আলোচিত তথ্য ও বিশ্লেষণ শুধু অতীতকে নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে।
একটিই প্রশ্ন বারবার ফিরে আসবে—রাষ্ট্রসংঘ কি সহিংসতা ও পক্ষপাতহীনভাবে বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে?
নাকি এটি ছিল এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকৌশলের অংশ?
