বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯৩৭ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা ঘোষণা দিয়েছে। তবে পদ্মা অয়েলের কাছে ২১০০ কোটি টাকার জেট ফুয়েল বকেয়া রেখে এই মুনাফা কতটা টেকসই—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯৩৭ কোটি টাকা অনিরীক্ষিত মুনাফার ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছরে এটিই সর্বোচ্চ লাভ। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, উন্নত যাত্রীসেবা এবং আধুনিকায়িত বহরের কারণে বিমান এই সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এর উল্টোপিঠে রয়েছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা—রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েলের কাছে বিমানের ২১০০ কোটি টাকার বকেয়া।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিমানের মোট আয় হয়েছে ১১,৬৩১.৩৭ কোটি টাকা।
প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকভাবে দুই অর্থবছর ১০ হাজার কোটির বেশি আয় করতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটি।
৩.৪ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন, ৪৩,৯১৮ টন কার্গো সরবরাহ এবং ৮২ শতাংশ কেবিন ফ্যাক্টর অর্জন করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনীয়।
বিমানের বিজ্ঞপ্তি বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সর্বকালের সর্বোচ্চ টিকিট বিক্রির রেকর্ডও গড়েছে তারা।
বহরে রয়েছে অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৮৭-৮ এবং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, আর নিজস্ব রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা খরচ সাশ্রয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু পদ্মা অয়েল, যা বাংলাদেশে একমাত্র জেট ফুয়েল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, দাবি করেছে বিমানের কাছে তাদের পাওনা ২১০০ কোটি টাকা।
বিপিসির এক কর্মকর্তা স্পষ্ট করেছেন, সর্বশেষ জুন মাস পর্যন্ত এই বকেয়া দুই হাজার কোটির নিচে নামেনি।
অর্থাৎ বিমান আসলে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত নয়।
প্রশ্ন উঠছে—
বকেয়া দায় মেটানো ছাড়াই কীভাবে লাভ ঘোষণা করা হলো?
সাধারণ কর্পোরেট চর্চায় এটি “ক্যাশ ফ্লো” এবং “প্রফিট” এর পার্থক্য তৈরি করে।
তবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা হওয়ায় বিমানের জন্য এই বকেয়া আপাতত কোনো সংকট তৈরি করছে না।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে পদ্মা অয়েলের তারল্য সংকটে এটি প্রভাব ফেলতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটি নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল—বছরের পর বছর লোকসান, দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নতুন ব্যবস্থাপনা হঠাৎ করেই রেকর্ড মুনাফার ঘোষণা দিয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে—
এটি কি শুধুই দক্ষ প্রশাসনের ফল, নাকি হিসাবের রঙচঙে উপস্থাপন?
কারণ, ২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের পর গত ১৮ বছরে বিমানের পুঞ্জীভূত মোট মুনাফা মাত্র ৫৮৯ কোটি টাকা।
অথচ এক অর্থবছরেই ৯৩৭ কোটি টাকার মুনাফা, এবং একইসঙ্গে ২১০০ কোটি টাকার দায় বকেয়া রাখা—এটি একধরনের আর্থিক বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স হিসেবে বিমানের প্রতি মানুষের আবেগ রয়েছে।
যাত্রীসেবার উন্নতি ও বহরের আধুনিকায়ন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি হলো আর্থিক স্বচ্ছতা।
একদিকে সর্বোচ্চ মুনাফার প্রচারণা, অন্যদিকে জ্বালানির সরবরাহকারীর প্রতি দায় উপেক্ষা—এটি ভবিষ্যতে নীতি-সংকট তৈরি করতে পারে।
কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এভাবে একে অপরের ওপর দায় চাপানো হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারি কোষাগারই।
বিমানের রেকর্ড মুনাফা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য ইতিবাচক সংবাদ।
তবে এর সাথে জড়িত আর্থিক দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
পদ্মা অয়েলের বকেয়া শোধ না করলে এই সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স হিসেবে বিমানের উচিত স্বচ্ছ আর্থিক চর্চা অনুসরণ করে যাত্রী আস্থা বজায় রাখা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতি দায় শোধে অগ্রাধিকার দেওয়া।
নয়তো এই মুনাফার ঘোষণাও ইতিহাসের এক “অর্ধসত্য” হিসেবেই থেকে যাবে।
