বাংলাদেশ সরকার নতুন নোট ছাপাতে খরচ করছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থে একটি পদ্মা সেতু বা হাজারো স্কুল ভবন নির্মাণ করা যেত। তাহলে এই সিদ্ধান্তের পেছনের আসল উদ্দেশ্য কী?

বাংলাদেশের বাজারে নতুন টাকা আসা কোনো নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু এবারের প্রক্রিয়াটি শুধু ‘নতুন’ নয়—অত্যন্ত ব্যয়বহুলও। চলতি অর্থবছরের ঈদ উপলক্ষে বাজারে আসা নতুন নোটগুলোকে কেন্দ্র করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যয়। প্রশ্ন উঠেছে—এই ব্যয় কি অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক? নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক কোনও বার্তা রয়েছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ছাপানো নোট আকারে বাজারে আছে প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে কয়েনের পরিমাণ ধরা হয় ৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
পুরনো সব নোট ধীরে ধীরে তুলে নতুন নোট ছাড়ার এই উদ্যোগে সরকার গড়ে প্রতি ১০০ টাকা ছাপাতে ২ টাকা খরচ করছে বলে বিবেচনা করলে, শুধু নোট ছাপাতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর কয়েন ছাপাতে খরচ আরও ৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট খরচ ১৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।
এই বিপুল অর্থ যদি অন্য খাতে ব্যয় হতো, তবে দেশের সাধারণ মানুষ তার সুফল ভোগ করতে পারত। কিছু উদাহরণ দেখা যাক:
একটি পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আরেকটি সেতু নির্মাণ প্রায় সম্ভব হতো।
৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০ হাজারে নতুন ভবন নির্মাণ সম্ভব হতো, প্রতিটিতে গড়ে ১ কোটি টাকা ব্যয়ে।
দেশের ১০০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে ২ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয়া যেত। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বছরের গবেষণা বাজেট মাত্র ২০ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা ৬০০ টাকার পরিবর্তে ১০০০ টাকায় উন্নীত করা যেত—যা দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারত।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এই জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করতে এই অর্থ বড় ভূমিকা রাখতে পারত।
সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যয়ের যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা এখনো আসেনি। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডিজাইন পরিবর্তন ও নতুন মেশিনে ছাপানোর দোহাই দিয়ে এই বিশাল ব্যয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে যখন পুরনো মেশিনেও টাকা ছাপানো যেত এবং ডিজাইন পরিবর্তন ছাড়াও নোট সচল রাখা যেত।
কেনো ছাপাচ্ছে জানেন? শুধু পুরোনো সব নোটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আছে বলে! শুধু তাই না, বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে বলে গত রমযান ঈদে নতুন কোন নোটই বাজারে ছাড়া হয় নাই!
নির্বাচনের আগেই অন্তবর্তীকালীন সরকার যেভাবে নোটের ডিজাইন পাল্টে, পুরনো নোট তুলে, নতুন মেশিন বসিয়ে এই বিশাল ব্যয়ে নতুন নোট ছাপাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রতীকমূলক সিদ্ধান্ত।
এক ধরনের ‘স্মারক সংস্কার’ যেখানে ব্যয় বিবেচনার চেয়ে প্রভাবশালী প্রতীকের অবস্থানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
- অর্থনীতিতে টান পড়বে বৈদেশিক ব্যয় বাড়ায়।
- মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বাড়বে কারণ বাজারে নতুন টাকার সঞ্চালন বাড়ছে।
- সাধারণ জনগণের আস্থা কমতে পারে, যেহেতু নোটের স্থায়িত্ব ও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
- সরকারি ব্যয়ের অগ্রাধিকার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ এভাবে প্রতীকী সিদ্ধান্তে খরচ করা কতটা যৌক্তিক? অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে সরকার যদি এই অর্থ জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করত, তবে তার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী সুফল মিলত। শুধু একটি ছবির জন্য যদি হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তাহলে সত্যিই আমাদের প্রশ্ন তোলা উচিত—আমাদের অগ্রাধিকার আসলে কী?
