বিবিসি সম্প্রতি বাংলাদেশে সহিংসতা নিয়ে প্রকাশিত ভিডিওতে কীভাবে তথ্য উপস্থাপনে পক্ষপাত ও রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রতিফলিত করেছে, তার গভীর বিশ্লেষণ। অডিও ক্লিপ, আইনজীবী নির্বাচনের পেছনের রাজনৈতিক সম্পর্ক, ও সহিংসতার অনুপস্থিত তথ্য উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ‘আনকভারিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি ৩৫ মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দাবি করা হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের বিক্ষোভ দমন অভিযানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেন। এই দাবির ভিত্তি একটি মাত্র ১৮ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপ, যার প্রামাণ্যতা, প্রেক্ষাপট ও উৎসই প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে এই প্রতিবেদনটিকে ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ বলা হলেও সেটিতে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা, প্রামাণ্যতা এবং পেশাদারিত্বের মৌলিক নীতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে একটি পক্ষীয় এজেন্ডার অনুসরণ করা হয়েছে—যা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে।
বিবিসি যেই ১৮ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপকে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেছে, সেটির উৎস, প্রাপক, কিংবা প্রেক্ষাপট কিছুই সুনির্দিষ্ট নয়। ক্লিপটিতে কোনো দৃশ্যমান বা নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্টচেক হয়নি। ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট জানিয়েছে, এটি “সম্ভবত কৃত্রিম নয়”—তবে তারা একে ‘নকল হওয়া অসম্ভব’ও বলেনি। অর্থাৎ, অডিওর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
অডিওর সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিবিসি যাদের মতামত নিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পটভূমিও পক্ষপাতের প্রমাণ দেয়।
যেমন—টবি কেডম্যান, যিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের অংশ।
অথচ, বিবিসি গোপন রেখেছে যে কেডম্যান জামায়াতের পক্ষে আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং এখনো জামায়াত-ঘনিষ্ঠ গের্নিকা ৩৭ চেম্বারে যুক্ত।
প্রতিবেদনে যেসব আইনজীবীদের উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পুরনো সংশ্লিষ্টতা আছে।
এমনকি ৫ আগস্টের আগেও তারা আন্দোলনকারীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছেন।
এতে প্রশ্ন উঠে, এই প্রসিকিউটররা কি আদৌ নিরপেক্ষ? নাকি রাজনৈতিক বিচার নিশ্চিত করতে নিয়োজিত একপক্ষীয় যোদ্ধা?
বিবিসি ১৭ জুলাই শেখ হাসিনার জাতীয় ভাষণের মাত্র এক মিনিটের কম অংশ তুলে ধরে একে ‘বিক্ষোভ দমন সংক্রান্ত নির্দেশ’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
অথচ সেই একই বক্তব্যে তিনি নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করেছিলেন, সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে চক্রান্তকারীদের পার্থক্য করেছিলেন এবং আদালতের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এসব বিবিসি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে।
সহিংসতা চালিয়েছে কারা?
বিবিসি দেখায়নি যে পুলিশের ওপর হামলা, অস্ত্র লুট, জেল ভাঙা, ও পুলিশ সদস্যদের হত্যা চলছিল বহু জায়গায়।
৫ আগস্টের আগেই যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের সহিংসতা ছিল স্পষ্ট।
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেও সহিংসতা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পরও সহিংসতা অব্যাহত ছিল।
দেশের ৪৫০টির বেশি থানায় হামলা হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে—যা এই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যে, সহিংসতার নির্দেশ শেখ হাসিনা দিয়েছেন।
হিযবুত তাহরীর ও অন্যান্য উগ্র সংগঠনের সম্পৃক্ততা
বিবিসি বাংলার এক ভিডিওতে হিযবুত তাহরীর নেতার স্বীকারোক্তি আছে যে তারা সাধারণ ছাত্র ছদ্মবেশে সহিংসতায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্করণে এই তথ্য নেই।
বিবিসি’র এই তথাকথিত অনুসন্ধান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসের দপ্তর এক চাপ সৃষ্টির প্রচারণা শুরু করে। এমন সময়ে, যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে বিচারপ্রক্রিয়া ও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সমালোচনায় সরব, তখন এই ভিডিও তাদের পক্ষে যুক্তি তৈরির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিবিসির এই প্রতিবেদন একটি পূর্বনির্ধারিত রাজনৈতিক বয়ানকে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের একটি দৃষ্টান্ত।
অডিও ক্লিপের মতো দুর্বল প্রমাণ, পক্ষপাতদুষ্ট আইনজীবী নির্বাচন, বক্তব্য কাটছাঁট করে উপস্থাপন এবং সহিংসতার মূলচিত্র আড়াল করা।
সব মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার জন্য এক বিপজ্জনক নজির।
সাংবাদিকতা সত্য অনুসন্ধানের মাধ্যম হলেও, এটি যখন একটি পক্ষের রাজনৈতিক এজেন্ডা বহন করতে শুরু করে, তখন তা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং ন্যায়ের শত্রুতে পরিণত হয়।
