 
                  ৫ বিলিয়ন ডলারে ২৫টি বোয়িং কেনার মাধ্যমে বিমানের দুর্নীতিকে ছুতো করে সামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্তাদের বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার ব্লুপ্রিন্ট এখন প্রকাশ্য।
২০০৭ সালের ১/১১ সেনা-সমর্থিত অঘোষিত সামরিক সরকারের শাসনকাল এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুচর্চিত এবং বিতর্কিত অধ্যায়। সেসময়ে দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে কোণঠাসা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয় ‘সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্তির’ ছদ্মবেশে। অথচ তাদের প্রথম বড় অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির কাছে ১০টি বিমান কেনার অর্ডার দেওয়া—যা প্রশ্ন তোলে, কে কার ‘লবিস্ট’ ছিল? ২০২৫ সালে এসে সেই একই নাটকের রিমেক যেন আবারও মঞ্চস্থ হচ্ছে—এইবার তার মুল্য ৫ বিলিয়ন ডলার এবং সংখ্যাটি ২৫টি বোয়িং বিমান।
সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে নানা অপারেশনাল ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হচ্ছে.
যদিও সেগুলোর অনেকটাই ব্যবস্থাপনা-নির্ভর, রাজনৈতিক-নিয়োগ নির্ভর, এবং মেরামত ও প্রশিক্ষণ ঘাটতির ফল।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুর্নীতির গল্প আসলে পাবলিক সিম্প্যাথি তৈরির পলিটিক্যাল টুল—যার মাধ্যমে বিমানের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার অংশবিশেষ বিদেশি কোম্পানি বা যৌথ বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে:কেন এখনই? উত্তর লুকিয়ে আছে ২০২৪ সালের ‘গণ-দাঙ্গা’ ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে।
২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে ‘আন্দোলন’ গড়ে ওঠে, তার আড়ালে ছিল স্ট্র্যাটেজিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার
—যেমন: বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বিদেশী হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা।
এসব খাতের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই দাঙ্গার ফলেই সরকারপন্থী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়, রাজনৈতিক সরকার হটে, এবং ছায়া-নিয়ন্ত্রিত টেকনোক্রেট প্রশাসন গঠিত হয়—যাদের নীতিগত দায় নেই জনগণের প্রতি, বরং বৈদেশিক দাতাদের প্রতি অনুগত।
বর্তমানেও অবসরে যাওয়া বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তা, যারা সরাসরি বেসামরিক প্রশাসন, বিমান, শিপিং কর্পোরেশন এবং জ্বালানি খাতে কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন
—তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ এই বেসরকারীকরণ।
ধারণা করা হচ্ছে, অবসরে যাওয়ার পর তারা এই বিদেশি কোম্পানিগুলোর “লিয়াজোঁ অফিসার”, “কান্ট্রি ম্যানেজার” বা “রিজিওনাল হেড” হিসেবে নিযুক্ত হবেন।
এ যেন এক পলিটিক্যাল-ইকোনমিক এক্সচেঞ্জ—আপনি সাময়িকভাবে ক্ষমতা দিন, আমরা ভবিষ্যতের কর্পোরেট পদের ব্যবস্থা করি।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:
এইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণ এত নিঃশব্দ কেন? বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদ একটা মনস্তাত্ত্বিক রাজনৈতিক প্রবণতা।
যেকোন রাজনৈতিক শক্তিকে ভারতঘেঁষা বলেই চিত্রিত করা হলে, মানুষ সামরিক কর্তাদের দিকেই আস্থা রাখতে শুরু করে।
এই সুযোগে “সামরিক কর্তৃত্ব = স্বাধীনতা” এমন এক বিভ্রম তৈরি হয়—যা প্রকৃতপক্ষে দেশের অর্থনৈতিক নিপীড়নের ভিতরকার ফাঁদে পরিণত হয়।
বিমানের ৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি শুধুই একটি ব্যবসা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ব্লুপ্রিন্ট, একটি অদৃশ্য শাসনযন্ত্রের বৈধতা অর্জনের কৌশল, যেখানে জনগণ কর দেবে, সম্পদ হারাবে, অথচ শাসনের অধিকার থাকবে না।
“যে সমাজ উপকারীকে ঘৃণা করে, সেখানে শয়তান রাজত্ব করে”— এই বাক্যটি আজ শুধুই ধর্মীয় বা নীতিবাক্য নয়, বরং বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতির বাস্তব ব্যাখ্যা।

 
                         
         
         
        