“আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কোটি গুণ শুকরিয়া, হায়াত না থাকলে কেউ বাঁচে না, আর হায়াত থাকলে কেউ মারতে পারে না।”
“হায়াত থাকলে মৃত্যু নেই“—এই প্রবাদটি যেন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন রিয়াজ মাহমুদ হৃদয়- সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট ভোরে রাজধানী ঢাকার অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর হাতে গুম, নির্যাতন ও সম্ভাব্য হত্যাচেষ্টা থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। তার নিজের বর্ণনায় উঠে এসেছে এক ভয়াল রাতের বিভীষিকা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বাস্তব চিত্র এবং বেঁচে ফেরার এক হৃদয়স্পর্শী অধ্যায়।
শৈশবের স্মৃতিবহ অফিসের সামনে থেকে শুরু
৫ আগস্ট রাত পেরিয়ে ৬ আগস্ট শুরু হওয়ার পর রাত আনুমানিক ২টার দিকে আদাবর ছাত্রলীগের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
বহু স্মৃতিবিজড়িত সেই অফিস তখন ভাঙচুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত। হঠাৎ একটি ছেলে গেট খুলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে সে পালিয়ে যায়।
তখনই তার এক বন্ধু এসে পৌঁছায় বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
গাড়িতে বসে আদাবর থানা অতিক্রমের সময় দেখতে পান কিছু লোক থানার জব্দকৃত গাড়ির যন্ত্রাংশ ও আসবাবপত্র সরাচ্ছে।
শ্যামলীর পুরনো অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে অনুরোধ করেন—কারণ “আর কবে দেখতে পাবো জানি না।”
বিমানবন্দরে প্রবেশ ও সন্দেহজনক পরিস্থিতির শুরু
রাত ৩টার আগেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। তার ফ্লাইট ছিলো ৬ আগস্ট ভোর ৫:৩০ টায়।
প্রবেশের পর জানতে পারেন ফ্লাইট ডিলে হয়ে সকাল ১০:৩০ টায় ছাড়বে। আশেপাশে প্রায় ৫০-৬০ জন পরিচিত মুখ ছিল।
পরিচিতরা বিদেশযাত্রায় ব্যস্ত থাকলেও, তার আশপাশে নজরদারির মতো কিছু আচরণ লক্ষ্য করেন তিনি।
সকাল ৭টার দিকে জানা যায়, ফ্লাইট আবারও ডিলে হয়ে বিকেল ৫টায় ছাড়বে।
ইমিগ্রেশন জটিলতা ও সন্দেহজনক আটকের ঘটনা
১২টার পর বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন রুমে প্রবেশ করেন। সেখানেই এক এসবি (বিশেষ শাখা) অফিসার তাকে চিনে ফেলে
এবং রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করতে থাকে। তিনি তখনই দেখতে পান তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে।
প্রথমে তাকে কিছু সময় অপেক্ষা করিয়ে ছেড়ে দিলেও, পরে ফের আটক করা হয়।
একই সময় সৈকত নামের আরেক সহযাত্রীকেও ইমিগ্রেশন থেকে আটক করা হয়।
তারা জানার চেষ্টা করেন—কোনো অভিযোগ, মামলা বা গ্রেফতারের ভিত্তি আছে কিনা। কোনো সদুত্তর না দিয়ে হুমকি দিয়ে বলা হয়—“এক পাড়া দিয়ে ভুরি বের করে ফেলবো।”
নির্জন নদী তীরে প্রাণনাশের চেষ্টা
পরে দু’জনকে হেলমেট ও লাইফজ্যাকেট পরিয়ে একটি গাড়িতে তোলা হয়। বলা হয় নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু গাড়িটি ৩০০ ফিট রোড হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একদম নির্জন, অন্ধকার নদীতীরে। সেখানে তিনি অনুরোধ করেন,
“এক হাত ভেঙে দিন, কিন্তু আমাকে মারবেন না। আমি মায়ের একমাত্র ছেলে।”
সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে একটি মেসেজ পাঠানোর অনুমতি পান:
“তোমরা সবাই ভাল থেকো, আমার জন্য দোয়া করো।”
এরপর ফোন, পাসপোর্ট ফেলে শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। গলায় বুটের দাগ, শরীরজুড়ে আঘাত, অচেতন অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয় পাশের নদীতে।
অলৌকিক উদ্ধার ও পুনর্জন্ম
কিছু সময় পর স্থানীয় কিছু তরুণ তাকে খুঁজে পান এবং মুখে আলো ফেলে চিনে ফেলেন।
তারা তাকে উদ্ধার করে মৈনারটেক হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতেই তাকে স্থানান্তর করা হয় এভার কেয়ার হাসপাতালে।
সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, তার ডান পাশের পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন।
৭ আগস্ট জ্ঞান ফিরে আসার পর জানতে পারেন পাশের কেবিনে মতিয়া চৌধুরী ও আমির হোসেন আমুর মতো ব্যক্তিত্বরাও ভর্তি ছিলেন।
পরবর্তীতে পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তার জন্য জোর করে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেন।
প্রাণে বেঁচে ফেরা ও অনন্ত কৃতজ্ঞতা
এই অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে একটাই সত্য:
আল্লাহ না চাইলে, কেউ কাউকে মারতে পারে না।
তিনি বলেন—
“আমি ছোটবেলা থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি, কাউকে কখনো ক্ষতি করিনি।
আমার পাশে ছিলো আল্লাহ, আমার মা, আর অসংখ্য মানুষের দোয়া।
এই দুনিয়াতে যদি কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস রাখি, সেটি হলো দোয়া ও নিয়তি।”
তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম ভাইয়ের,
এবং তার বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি, যাঁরা তাকে বাঁচাতে ভূমিকা রেখেছেন।
শেষ কথা
৬ আগস্ট দিনটি তার জীবনে শুধুই একটা তারিখ নয়, বরং তৃতীয়বার নতুন জীবন পাওয়ার দিন। তিনি লিখেছেন—
“আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে কোটি গুণ শুকরিয়া, হায়াত না থাকলে কেউ বাঁচে না, আর হায়াত থাকলে কেউ মারতে পারে না।”
