 
                  বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের প্রতিযোগিতা দেশটির সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার বড় হুমকি তৈরি করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রে এখন বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, চীন-রাশিয়ার পাল্টা সক্রিয়তা এবং ভারতের সরকারবিরোধী কূটনৈতিক অবস্থান দেশটিকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য স্পষ্ট—বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের নতুন কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত করা।
সাম্প্রতিক সামরিক পরিবহন বিমান ও যুদ্ধবিমানের অবতরণ সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই ইঙ্গিত বহন করছে।
এর ফলে বাংলাদেশ অজান্তেই বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
চীন ও রাশিয়া পাল্টা চাপ সৃষ্টি করবে, যা ঢাকার স্বাধীন কূটনীতিকে সংকুচিত করবে এবং সার্বভৌম নীতি কার্যত বিদেশি শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে যাবে।
এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতায় আসাকে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
তাকে আন্তর্জাতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন স্বার্থবান্ধব নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইউনূসের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশ আরও গভীরভাবে মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা শুধু অর্থনীতি বা সামরিক ঘাঁটি নয়; বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকেও রূপান্তরিত করা।
বিশেষ করে জামাত ও নবগঠিত এনসিপিকে সামনে এনে দেশটিকে ইরানধাঁচের একটি “আধুনিক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে” রূপান্তরিত করার চেষ্টা স্পষ্ট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে এই বৃহত্তর কৌশলের পরীক্ষামূলক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে।
বিদেশি দ্বন্দ্বের প্রভাব অর্থনীতিতেও তীব্র হবে।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে প্রথম আঘাত আসবে পোশাকশিল্পে।
অন্যদিকে চীনের ঋণনির্ভরতা বাংলাদেশকে ঋণফাঁদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ কমলে রপ্তানি, রিজার্ভ ও কর্মসংস্থানে ধস নামতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বাড়লে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নতুন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে।
মিয়ানমার সীমান্ত অস্থিরতা ও বঙ্গোপসাগরে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা ঢাকার নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়াবে।
একই সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যকলাপ সমাজকে বিপজ্জনক পথে ঠেলে দেবে।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখার ফলে কার্যত একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
এই শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি শক্তি।
গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন আন্তর্জাতিক সমীকরণে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভারতের ভূমিকা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় মিত্র হয়েছিল।
আজকের অস্থির প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—নরেন্দ্র মোদী কি একাত্তরের মতো আবারও কৌশলগত সহায়তার হাত বাড়াবেন, নাকি বাংলাদেশ সিরিয়া, লিবিয়া বা আফগানিস্তানের মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে?
বাংলাদেশ এখন পড়েছে এক শাখের করাতের নিচে।
একদিকে মার্কিন স্বার্থ, অন্যদিকে চীন-রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান দেশটিকে এক অভূতপূর্ব সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীন ও স্বার্থকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

 
                         
         
         
        