আইএমএফের সতর্কবার্তা—মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে। সংস্কার ছাড়া কিস্তি অনিশ্চিত। ঝুঁকিতে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা!
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক জটিল ও গভীর সংকটের মুখে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, দেশের অর্থনীতি এখনো তীব্র চাপে রয়েছে এবং স্থিতিশীলতা ফেরানো সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
সংস্থাটি সতর্ক করেছে—মূল্যস্ফীতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে অর্থনীতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কঠোর নীতির আহ্বান
আইএমএফ জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামাতে হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান নীতি সম্পর্কে সংস্থাটি বলেছে, “সুদহার নীতিতে স্বচ্ছতা নেই এবং বাজারভিত্তিক নয়।”
তাদের মতে, কৃত্রিমভাবে নির্ধারিত সুদের হার মুদ্রানীতিকে অকার্যকর করে তুলছে এবং বিনিয়োগ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
খেলাপি ঋণ: অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি
আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছরে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে।
বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপির হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে—যা সংস্থার নির্ধারিত সীমার প্রায় চার গুণ।
একজন প্রতিনিধির ভাষায়—
“খেলাপি ঋণ এখন শুধু ব্যাংকের নয়, দেশের আর্থিক ভবিষ্যতের ওপর ছায়া ফেলছে।”
রিজার্ভের চাপ ও রাজস্ব ঘাটতি
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নিট বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ২০.৫ বিলিয়ন ডলার, যা আপাতদৃষ্টিতে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালেও বাস্তবে অস্থায়ী উন্নতি।
সংস্থাটি বলেছে, রাজস্ব ঘাটতি ও কর-জিডিপি অনুপাতের দুর্বলতা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
আইএমএফ আরও সতর্ক করেছে যে—
যদি আমদানি ব্যয়, ঋণ পরিশোধের চাপ ও রাজস্ব ঘাটতি একসাথে বেড়ে যায়, তাহলে রিজার্ভ ধরে রাখা অসম্ভব হবে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোতে জামানতবিহীন অর্থ সহায়তা
আইএমএফ তীব্র আপত্তি জানিয়েছে রিজার্ভ থেকে ইডিএফ (Export Development Fund) ও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে জামানতবিহীন তারল্য সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে।
তারা বলেছে, এই “ইনসিকিউর্ড লেন্ডিং” নীতি আর্থিক ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সূত্র অনুযায়ী, প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে, যাদের কাছে কোনো সরকারি বন্ড বা জামানত ছিল না।
ফলাফল—এই অর্থের বড় অংশ ফেরত আসছে না।
আইএমএফের ঋণ কিস্তি ঝুলে গেল
বাংলাদেশ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির অধীনে আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় ডিসেম্বরে নির্ধারিত ষষ্ঠ কিস্তি ঝুলে গেছে।
আইএমএফ জানিয়েছে, বাস্তব সংস্কার ছাড়া তারা নতুন কোনো কিস্তি ছাড় করবে না।
আইএমএফ মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন—
“বাংলাদেশ কিছু অগ্রগতি দেখিয়েছে, কিন্তু সংস্কারের পথে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ব্যাংক খাতের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে না আনলে স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
বিশ্লেষণ: সামনে কোন পথ বেছে নেবে বাংলাদেশ?
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের বর্তমান সংকট একটি “স্ট্রাকচারাল ক্রাইসিস”—
যেখানে মুদ্রানীতি, রাজস্ব কাঠামো, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও রিজার্ভ ব্যবহারে একযোগে সংস্কার প্রয়োজন।
একজন সিনিয়র অর্থনীতিবিদের মন্তব্য:
“মূল সমস্যা রাজস্ব ঘাটতি নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা। কঠিন সংস্কার ছাড়া পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”
সরকার এখন এক জটিল সমীকরণে আটকে আছে—
- আইএমএফের কঠোর শর্ত মানলে জনঅসন্তোষ বাড়বে
- না মানলে আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে
সারসংক্ষেপ
মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও রাজস্ব ঘাটতির ত্রিমুখী চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক গভীর টালমাটাল পরিস্থিতিতে।
আইএমএফের বার্তা স্পষ্ট—“সংস্কার নয়, স্থিতিশীলতা।”
এখন প্রশ্ন—সরকার কি সেই সাহসী সংস্কারের পথে হাঁটবে, নাকি রাজনৈতিক স্বস্তির জন্য অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে আরও বাড়াবে?
সূত্র:
- IMF Country Report: Bangladesh 2025 (imf.org)
- বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা, অক্টোবর ২০২৫
- Reuters Economic Outlook on Bangladesh, 2025
