প্রেস সচিবের “নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানা বন্ধ হওয়া খারাপ কিছু না” মন্তব্যে তোলপাড় গার্মেন্টস খাত; বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি রপ্তানি অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
প্রেস সচিবের বিতর্কিত মন্তব্যে গার্মেন্টস খাতে তোলপাড় !
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের একটি বক্তব্য। তিনি সম্প্রতি বলেছেন,
“নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানা বন্ধ হওয়া দেশের জন্য খারাপ কিছু না।”
এই একবাক্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গার্মেন্টস মালিক, শ্রমিক নেতা ও অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এটি কেবল অজ্ঞতাপ্রসূত নয়, বরং বাংলাদেশের রপ্তানি অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী এক বক্তব্য।
লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবিকা হুমকিতে
বর্তমানে দেশের গার্মেন্টস খাতে প্রায় ৪৫ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত। এর মধ্যে অন্তত দেড় থেকে দুই লক্ষ শ্রমিক নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলিতে কাজ করেন। বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, এই ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো পিক সিজনে কমপ্লায়েন্ট কারখানার অতিরিক্ত অর্ডার সম্পন্ন করে।
এই কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে শুধু শ্রমিক নয়, তাদের পরিবারের চার থেকে পাঁচ গুণ মানুষ জীবিকার অনিশ্চয়তায় পড়বে।
“একটা কারখানা বন্ধ মানেই চার-পাঁচটা পরিবার রাস্তায়,”
বলেছেন গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ।
রপ্তানিতে ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন—
“প্রেস সচিব জানেন না, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পিক সিজনে সাব-কন্ট্রাক্ট ছাড়া রপ্তানি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।”
গার্মেন্টস খাতের মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আসে এই সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে।
এই সাব-কন্ট্রাক্টের বড় অংশই সম্পন্ন হয় তথাকথিত “নন-কমপ্লায়েন্ট” কারখানাগুলোতে।
যদি এই কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তবে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন H&M, ZARA, WALMART—তাদের অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বা কাবোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে। এর ফলে বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হবে।
অর্থনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা
ড. আহসান এইচ মনসুর, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, মন্তব্য করেছেন—
“এটা যেন কেউ বলছে অসুস্থ রোগীকে অপারেশন না করে মেরে ফেলাই ভালো।”
তিনি বলেন, নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোর সমস্যা আছে ঠিকই, কিন্তু সমাধান হলো আপগ্রেডেশন, ফাইন্যান্সিং ও ট্রেনিং, বন্ধ করা নয়।
তার মতে, এই খাত বন্ধ হলে বাংলাদেশের রিজার্ভে চাপ, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং ঋণ খেলাপির হার বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।
শিল্প উদ্যোক্তা ও সংগঠনগুলোর দাবি
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যৌথভাবে সরকারের কাছে তিন দফা দাবি উত্থাপন করেছে:
- প্রেস সচিবের মন্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
- নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোর জন্য দুই বছরের রিমিডিয়েশন পিরিয়ড ঘোষণা করতে হবে।
- লো-ইন্টারেস্ট লোন ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রদান করে ধাপে ধাপে কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্ট পর্যায়ে আনা হোক।
সরকারের দায়সারা মনোভাব নাকি ব্যর্থতার আড়াল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেস সচিবের মন্তব্য মূলত সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার একটি প্রচেষ্টা।
গত এক বছরে দেশের প্রায় ২৫৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই শ্রম আইন বা নিরাপত্তা নয়, বরং অর্ডার সংকটের কারণে বন্ধ হয়েছে।
তবুও সরকার বিষয়টিকে ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ ইস্যু বানিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রপ্তানি খাতের মেরুদণ্ডে আঘাত
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। এই খাত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মূল উৎস এবং কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র।
এই খাতের একটা অংশকেও ধ্বংস করে দেওয়া মানে গোটা অর্থনীতির মেরুদণ্ডে আঘাত হানা।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন—
“সরকারের ভুল বার্তা বিদেশি বায়ারদের কাছে নেতিবাচক সংকেত পাঠাচ্ছে।”
যদি সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে দক্ষিণ এশিয়ার পোশাক বাজারে প্রতিযোগিতা হারাবে।
পর্যবেক্ষণ
প্রেস সচিবের এই মন্তব্য শুধুই একটি অজ্ঞতাপ্রসূত বাক্য নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতি অবহেলার প্রতীক।
গার্মেন্টস খাতের সাফল্যের পেছনে আছে কোটি শ্রমিকের ঘাম, উদ্যোক্তার পরিশ্রম এবং বৈদেশিক বাজারে আস্থার সঞ্চয়।
এই আস্থা একবার হারালে তা ফিরে পেতে সময় লাগবে বহু বছর।
বাংলাদেশের জন্য এখন প্রয়োজন আত্মতুষ্টি নয়, বাস্তবভিত্তিক নীতি ও শিল্পবান্ধব পদক্ষেপ। অন্যথায়, কয়েকজনের অহমিকায় পুরো রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে।
রেফারেন্স লিংক:
- বিজিএমইএ অফিসিয়াল বিবৃতি, অক্টোবর ২০২5
- বিকেএমইএ প্রেস রিলিজ, নভেম্বর ২০২5
- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিশ্লেষণ, ড. আহসান এইচ মনসুর
