ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মিরাকল বলেই স্বীকৃত হয়েছিল; আজ তা ঋণজালের, রাজনৈতিক আগ্রাসনের ও বিদেশী প্রতিচ্ছবির প্রশ্ন উঠেছে। বলেছেন নীলা ইস্রাফিল। নীলা ইস্রাফিলের এই ফেসবুক স্টাটাসের উপর একটি সমসাময়িক বিশ্লেষণ।
মানবতাবাণী ও ব্যবসার মেলবন্ধন
৮০-এর দশকের শেষে যখন সংগ্রামী অর্থনীতিবিদগণ শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলছিলেন, তখন ড. ইউনূসের ধারণা ছিল — ছোট ঋণ দিয়েই গরিব নারী স্বাবলম্বী হতে পারবে, স্বপ্ন বুনবে। তিনি পাঠান গ্রামীণ নারীদের হাত ধরিয়ে, তাঁদের জন্য ‘মাইক্রোক্রেডিট’ প্রতিষ্ঠা করলে বিশ্ব তার নিয়ে আলোচনা করে উঠল। Wharton Global Youth Program+2Investopedia+2 কিন্তু বিরোধীরা বলছেন — এই ‘মানবতার’ বাণীটা রহস্যজনকভাবে “ঋণ ব্যবসার মুখোশ” হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, মাইক্রোক্রেডিট সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে ঋণগ্রস্থ নারীদের উপর সুদের বোঝা, গ্রুপ দায়বদ্ধতা, এবং পুনরায় ঋণ নেওয়ার সার্কুলাস এক আশঙ্কাজনক চিত্র ফেলে দিয়েছে। exhibitions.globalfundforwomen.org+1
ঋণজাল ও গরিবের বাস্তবতা
আপনার বক্তব্য অনুযায়ী — ‘‘হাজারো নারীর কান্না, যাদের ঘর বাঁচেনি, যাদের মর্যাদা ভাঙা সুদের নিচে পিষ্ট হয়েছে’’ — আসলে এই চিত্র কি অব্যাহত রয়েছে?
গবেষণা বলছে, মাইক্রোক্রেডিট অবশ্য অনেকের জন্য স্বাবলম্ব্যের পথ খুলেছে, কিন্তু একই সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণচক্র, আত্মহত্যা ও সামাজিক দ্বিধা সৃষ্টি করেছে। Le Monde.fr
যেমন বিদেশি এক নিবন্ধ বলছে:
“Often the poorest end up in layers of debt… microfinance can become a factor of enslavement rather than emancipation.”
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে — যে নারীকে শক্তিশালী করে তোলার কথা বলা হয়েছিল, তিনি কি সত্যিই সশক্ত হয়েছেন?
নাকি শুধু নামমাত্র ঋণগ্রহীতা হয়েছেন ও আসল স্বাধীনতা থেকে এক ধাপ দূরে চলে গেছেন?
আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং দেশীয় সমালোচনা
ইউনূস যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, তখন বিশ্ব তাঁর উদ্ভাবনী মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে “দারিদ্র্য বিমোচনের মিরাকল” হিসেবে দেখেছিল। Investopedia+1
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মঞ্চে এখন তার বিরুদ্ধে গুরুতর সমালোচনা শুরু হয়েছে — কর্পোরেট বিনিয়োগ, কর ছাড়, সরকারের সাথে অস্বচ্ছ সম্পর্ক, ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের অভিযোগ। New Age+1
এই দ্বৈত প্রতিচ্ছবি — বিশ্বের কাছে মানবতার চ্যান্সেলর, দেশে বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব— এটি অনুসন্ধানীয় এবং উদ্বেগজনক।
একজন সাংবাদিক হিসেবে যেখানে প্রশ্ন থাকে — কি কারণে এই অদৃশ্য বিপরীতে তিনি দাঁড়াতে পারলেন?
রাজনীতিতে উত্তরণ ও বিপরীতে বিশ্বাসের সংকট
আপনি লিখেছেন—‘‘তিনি রাজনীতির মঞ্চে নেমেছেন… পুরনো খেলা’’— আসলে কি ইউনূস রাজনীতিতে আগ্রহী?
ইতিহাস বলছে, ২০০৬-০৭ সময়ে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন—Nagorik Shakti— কিন্তু তা চলেনি। Wikipedia
পরে তিনি বলেন তিনি রাজনীতি করবেন না।
কিন্তু আজ তার রাজনৈতিক সংলাপ ও একাধিক সরকারি সংবিধানে তার সংযুক্তি রয়েছে।
এই মিশ্র পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের ভরসা কমে যাচ্ছে — ‘‘মানুষের বিশ্বাস একবার ভাঙলে তা ফেরানো যায় না’’ বলেই আপনি লিখেছেন।
প্রশ্ন: বক্তৃতা না কর্ম?
আপনার বক্তব্যে এক মৌলিক বিষয় উঠে আসে—‘‘কথা রাখার মানুষরা ত্যাগ করে, আর যারা কথাকে পুঁজিতে বদলায়,
তারা কেবল বক্তৃতা দেয়, কর্ম নয়’’— এটা মিডিয়া সমালোচনার অন্যতম মন্ত্র।
হয়তো মানুষ হিসেবে জানতে চাইবেন:
- মাইক্রোক্রেডিট মডেলে আপনি পরিবর্তন আনতে বলেছিলেন, আজ তার বাস্তব অবস্থা কী?
- রাজনৈতিক ভূমিকা নেয়ার পর আপনি কি কর্মের পরিমাণ বাড়িয়েছেন?
- দেশীয় গরিব-জনের জীবনে কী সার্থক পরিবর্তন হয়েছে?
- বিদেশি মিডিয়া ও কর্পোরেট দাতাদের চোখে ‘‘সাফল্যের প্রতীক’’ হয়ে ওঠা আপনার জন্য কি মানে রাখে?
উপসংহার
ড. ইউনূস — নামেই রয়েছে মানবতা ও উদ্ভাবনের বাণী। তবে আজ বিশ্বাসঘাতকতার মতো বিতর্কও রয়েছে তার নামে।
একজন সাংবাদিকের দৃষ্টিতে বিষয় হলো — প্রতিভা ও পুরস্কার বড় কথা, কার্যকর পরিবর্তন বড় কথা; কিন্তু বাস্তব জীবনে যদি হাজারো গরিব নারী ঋণচক্রে জড়িয়ে পড়ে, যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মানুষের বিশ্বাস হারায়, তাহলে ঘোষণা-বাণীর পেছনে প্রশ্ন বাড়ে।
আপনি লিখেছেন—‘‘তিনি নীতির নয়, পয়সার মানুষ’’— আপনি এই কঠোর ভাষায় বলছেন, কারণ আপনি হয়তো এক সাংবাদিক হিসেবে দেখতে পেয়েছেন যে বক্তৃতার ভেতরে কর্মের অভাব রয়েছে।
এই সরল কিন্তু ব্যঙ্গপ্রবণ সংক্ষেপে বলা যায়:
কথার মানুষ হয়েছিলেন, কিন্তু কি কাজের মানুষ হয়েছেন?
আজ আমাদের কাজ হলো শুধু প্রশ্ন তোলা নয়; উত্তর খোঁজা— যেগুলো গভীর মন্থন করে, সতর্ক চিত্র দেখিয়ে দেয়।
কারণ জনবিশ্বাস আজ সবচেয়ে বড় সম্পদ। একবার সেটা হারিয়ে গেলেই, যত নাম আর পুরস্কার থাকুক, তা আর ফিরিয়ে পাওয়া যায় না।
রেফারেন্স লিঙ্কস
- “Controversies mar the reputation of Nobel laureate Muhammad Yunus” — InDepthNews. indepthnews.net
- “Microfinance and the Backlash” — Stanford Social Innovation Review. ssir.org
- “Muhammad Yunus: The Banker to the Poor facing controversy” — Time. TIME
- “Bangladesh interim govt chief Yunus under criticism over privileges” — NewAge BD. New Age
- “Often the poorest end up in layers of debt…” — Le Monde. Le Monde.fr
