বিটিসিএলের ৫জি প্রকল্পে প্রকৃত প্রয়োজনের দ্বিগুণ ব্যয়, হুয়াওয়ে পছন্দের ঠিকাদার, বিশেষ সহকারীর হস্তক্ষেপ ও দুদকের তদন্তে বাধা—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থায় অস্বচ্ছতার বড় উদাহরণ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের এক উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি হিসেবে সামনে আনা হয়েছিল ‘৫জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ প্রকল্প। কিন্তু এখন এই প্রকল্পটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার বলয়ে গড়ে ওঠা প্রভাব বিস্তার, আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ, আর কোটি কোটি টাকার অস্বচ্ছ লেনদেনের প্রতিচ্ছবি।
মূল চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৬৫ কোটি টাকায় বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৬ কোটি টাকা।
অতিরিক্ত ১৬১ কোটি টাকার জবাবদিহিতা চেয়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার এক বিশেষ সহকারী—ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
বুয়েটের স্বতন্ত্র প্রযুক্তি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ ব্যান্ডউইথ চাহিদা হতে পারে ২৬.২ টেরাবাইট। অথচ বিটিসিএলের মাধ্যমে ক্রয় করা যন্ত্রপাতির ক্ষমতা ১২৬ টেরাবাইট! ৫ গুণ বেশি সক্ষমতা কেন? তা–ও ১৬৫ কোটি টাকার বাজেটের স্থলে ৩২৬ কোটি টাকা?
এখানে প্রশ্ন উঠছে—চাহিদার অতিরিক্ত প্রযুক্তি কেনার পেছনে প্রযুক্তিগত যুক্তি কতটা, আর ব্যক্তিগত স্বার্থ কতটা?
এই প্রকল্পে কাজ পেয়েছে বিতর্কিত চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। সরাসরি দরপত্র আহ্বান নয়, বরং ‘নির্বাচিত’ হয়ে তারা কাজ পেয়েছে বলে অভিযোগ।
দুদকের তদন্তেও উঠে এসেছে, হুয়াওয়ের চুক্তি প্রক্রিয়ায় সরকারি ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘিত হয়েছে।
এমনকি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে চাপ প্রয়োগের।
বিটিসিএলের সাবেক এমডি আসাদুজ্জামান চৌধুরী যখন এই প্রক্রিয়া ঠেকান, তাকে বরখাস্ত ও মামলায় জড়ানো হয়।
তবে সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হলো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের নিজস্ব প্যাডে দুদককে পাঠানো আধা-সরকারি চিঠি। যেখানে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান ব্যান্ডউইথ চাহিদা ৩৫ টেরাবাইট ছাড়িয়েছে, এবং ৫০% বার্ষিক প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতাকে যৌক্তিক বলেছেন।
তিনি আরও দাবি করেন, ২৯০ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়ে গেছে, প্রকল্প বাতিল হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে। অথচ দুদকের ভাষ্য অনুযায়ী, এমন চিঠি স্বাধীন তদন্তে হস্তক্ষেপ ও চাপ প্রয়োগের সামিল।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান স্পষ্টভাবে বলেছেন—‘তদন্তাধীন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চিঠি দেওয়া অনৈতিক এবং আইনি হস্তক্ষেপ।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হুয়াওয়ের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। এমন একটি সংস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প প্রদান আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
- প্রকল্পের প্রযুক্তি চাহিদার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত সক্ষমতার পেছনে কার স্বার্থ কাজ করেছে?
- প্রকল্প নিয়ে দুদকের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন প্রশাসনিক পর্যায়ে চাপ তৈরি করা হলো?
- হুয়াওয়ের মত বিতর্কিত কোম্পানিকে কাজ দিয়ে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ছে না?
- প্রকল্পটি কি ডিজিটাল উন্নয়নের অংশ, নাকি ডিজিটাল দুর্নীতির নতুন উদাহরণ?
‘৫জি উপযোগীকরণ’ একটি প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা হোক, সেটা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি এর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনানুগ প্রক্রিয়া।
প্রযুক্তির নামে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিগত সুবিধা এবং আমলাতান্ত্রিক চাপ দিয়ে কোনো প্রকল্প রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয় না, বরং ফেলে অন্ধকারের গহ্বরে।
