 
                  শহীদ পরিবারকে আবাসন দিতে নেওয়া ৩৬ জুলাই প্রকল্পে ৪৫ গুণ বেশি খরচ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, যা বালিশ কাণ্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে সরকারি প্রকল্প মানেই কি অনিয়ম আর হরিলুটের আরেকটি নতুন অধ্যায়? সম্প্রতি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ‘৩৬ জুলাই’ নামে প্রস্তাবিত শহীদ পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্প নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যয়ের হিসাব, যা “বালিশ কাণ্ড” বা “পর্দা দুর্নীতি”কেও যেন হার মানায়।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া পরিবারগুলোর জন্য বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা।
কিন্তু সেই মানবিক লক্ষ্যকে পুঁজি করে কীভাবে একটি দুর্নীতির প্রকল্পে পরিণত করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়।
প্রকল্পের একেবারে বুনিয়াদেই শুরু দুর্নীতির ছড়াছড়ি।
যেখানে একটি আরসিসি পিলার বাজারে ৯০০ টাকায় পাওয়া যায়, সেখানে এই প্রকল্পে তারই দাম ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা! অর্থাৎ প্রায় ৪৫ গুণ বেশি।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে—কে এই অঙ্ক অনুমোদন করলো, আর কী ভিত্তিতে?
- ১৮টি বেড লিফটের প্রকৃত বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা হলেও প্রকল্পে প্রতিটি লিফটের দাম ধরা হয়েছে ৯২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা করে, মোট খরচ ১৬ কোটি ৭২ লাখ!
- ৮০০ কেজির ১২টি প্যাসেঞ্জার লিফটের জন্য ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা, যেখানে প্রকৃত ব্যয় সর্বোচ্চ ৩.৫ কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
- ৬টি ১০০০ কেভিএ সাবস্টেশনের প্রকৃত ব্যয় যেখানে ২.৪ কোটি, সেখানে প্রস্তাব ৫.৯ কোটি টাকা!
- ২০ এইচপি পাম্পের বাজারদর যেখানে ৯৫ হাজার টাকা, সেখানে প্রতি ইউনিট ৪.৫ লাখ টাকা ধরে ব্যয় ধরা হয়েছে।
এভাবে শুধু বেসামাল ব্যয় নয়, বরং প্রতিটি উপাদানেই রয়েছে অনিয়ম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাজেট ফোলানোর প্রমাণ এবং শুধু আর্থিক নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতেও এই প্রকল্পের গলদ স্পষ্ট।
প্রকল্পে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, মাস্টারপ্ল্যান বা পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ।
ডিপিপি প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও নেই কোন স্বচ্ছতা।
ফ্ল্যাট বরাদ্দের শর্ত, শহীদের উত্তরাধিকার নির্ধারণ, সুবিধাভোগীদের তালিকা—সবই অন্ধকারে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারাও ডিপিপিতে ফিজিবিলিটি স্টাডি ও আউটপুট নির্ধারণের অভাব, প্রকল্প লগফ্রেমের দুর্বলতা, ও লক্ষ্যবস্তুর অস্পষ্টতা তুলে ধরেছেন।
তবুও, “জুলাই অভ্যুত্থান” এর আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের পথে এগোচ্ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে গেলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছেন।
প্রকৌশলী হারিজুর রহমান বলেন, তিনি পরিকল্পনার বিষয়ে জানেন না।
অন্যজন বলেন, ফিল্ড অফিস থেকে প্রাক্কলন আসে।
অথচ এটি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব ছিল তাদেরই ও এই দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতিই আজ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জায়গায় গভীর অনাস্থা তৈরি করছে।
একটি আবাসন প্রকল্প যেখানে শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনের প্রতীক হতে পারত, সেখানে তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতির প্রতিচ্ছবি এবং এই অনিয়ম-দুর্নীতির চক্র শুধু সরকারের নয়, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
জনগণের ট্যাক্সের টাকা এভাবে লুটপাট করতে দিতে পারে না কোনো সভ্য রাষ্ট্র।
তাই এখনই সময়—এই প্রকল্পে নিরপেক্ষ অডিট, দায়ীদের চিহ্নিত করা এবং জনগণের সামনে প্রকল্পের প্রতিটি দফা প্রকাশ করার।
অন্যথায়, শহীদদের নামেই ‘দুর্নীতির শহীদ মিনার’ গড়ে ওঠার আরেকটি অধ্যায় লিখবে ইতিহাস।

 
                         
         
         
         
         
         
        